শেখ হাসিনার পতন ও পলায়ন: ইতিহাসের এক অনিবার্য পরিণতি
বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় রচনা হলো ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট। টানা কয়েক সপ্তাহের প্রবল সরকারবিরোধী ছাত্র ও জনতার আন্দোলনের মুখে দেশের দীর্ঘদিনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশেষে পদত্যাগ করে দেশত্যাগে বাধ্য হলেন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই পতন আসলে শেখ হাসিনারই নিজের তৈরি করা পরিস্থিতির অনিবার্য ফলাফল।
প্রবল ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা সংস্কারের দাবিতে। শুরুতে এ দাবি ছিল শুধুমাত্র কোটা পদ্ধতির সংস্কার। কিন্তু শেখ হাসিনার অমনোযোগী ও কঠোর মনোভাব এবং আন্দোলনকারীদের প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য ছাত্রসমাজের ক্ষোভকে নতুন মাত্রা দেয়। দ্রুতই আন্দোলন “এক দফা এক দাবি” — শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে রূপ নেয়।
সরকারের কঠোর দমননীতির মুখেও ছাত্ররা পিছু হটেনি। পুলিশের গুলিতে শত শত ছাত্র নিহত হওয়ার পরও আন্দোলন থামেনি, বরং আরও বেগবান হয়। শেষ পর্যন্ত জনতার সুনামির সামনে শেখ হাসিনার কঠোর নিয়ন্ত্রণের দেয়াল ভেঙে পড়ে।
অন্ধ ক্ষমতার মোহ এবং জনবিচ্ছিন্নতা
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, শেখ হাসিনার পতন তার নিজের দীর্ঘদিনের শাসন নীতিরই ফল। তিনি রাষ্ট্রের শক্তি ব্যবহার করে আন্দোলন দমন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জনগণের দুর্ভোগ, ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি এবং শাসনযন্ত্রের প্রতি মানুষের হতাশা এতটাই গভীর ছিল যে, আর কোনো দমননীতি কাজ করেনি।
তাঁর সরকার সুবিধাভোগী শ্রেণিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। উন্নয়ন প্রকল্পের আড়ালে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের অবনতি, দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং ন্যায্য দাবিগুলো অবহেলা করাই তার সরকারের প্রতি মানুষের আস্থার পতনের কারণ হয়।

অতীতের মহিমা এবং বর্তমানের নির্মম বাস্তবতা
২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাসন শেষে দেশে ফিরে শেখ হাসিনা তরুণ সমাজের বিপুল সমর্থন নিয়ে অভূতপূর্ব বিজয় অর্জন করেছিলেন। সেই সময় তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার করে জাতির আবেগকে স্পর্শ করেছিলেন। কিন্তু পরে দেখা যায়, বিচারে পক্ষপাতিত্ব হয়েছে—নিজ দলের অপরাধীদের রক্ষা করা হয়েছে, বিরোধীদের নির্মূল করা হয়েছে।
২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন দমনে ভয়াবহ দমন-পীড়ন চালানো হয়। ঢাকা শহর রক্তাক্ত হয়েছিল। হাজার হাজার মাদ্রাসাছাত্র নিহত ও নিখোঁজ হয়েছিল। তারপরও শেখ হাসিনা উন্নয়ন ও অবকাঠামো নির্মাণের অঙ্গীকারের মাধ্যমে জনগণকে কিছু সময়ের জন্য ম্যানেজ করতে সক্ষম হন। কিন্তু সেই অঙ্গীকারগুলোও ধীরে ধীরে ফাঁপা প্রতিশ্রুতিতে পরিণত হয়।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি: কান্না, আবেগ ও প্রতারণা
শেখ হাসিনা প্রায়ই তার পারিবারিক ট্র্যাজেডি—১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি টেনে আনতেন এবং জনতার আবেগকে কাজে লাগাতেন। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিকে তিনি রাজনৈতিক অস্ত্র বানিয়ে ব্যবহার করতেন। বিরোধীদের রাজাকারের সন্তান বলে গালাগাল করে তিনি ঘৃণার রাজনীতি উসকে দিয়েছিলেন।
কিন্তু ২০২৫ সালে পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। তরুণরা আর আবেগের ফাঁদে পা দেয়নি। তারা তার পুরনো কৌশলগুলো ভেদ করে তাদের ন্যায্য দাবির পক্ষে অটল থেকেছে। শেখ হাসিনার ‘দেবীতুল্য’ ভাবমূর্তি এ প্রজন্মের কাছে আর গ্রাহ্য ছিল না।
আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া এবং চূড়ান্ত পতন
দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলেও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমে উঠছিল। তার সরকারের কর্তৃত্ববাদী আচরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণতন্ত্রবিরোধী কার্যকলাপের কারণে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেক দেশ তার সরকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র তার সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যা ছিল আন্তর্জাতিক মহলে তার সরকারের পতনের পূর্বাভাস।
চীনকেও ক্ষুব্ধ করে তোলেন তিনি ভারতের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতার মাধ্যমে। ফলে বাংলাদেশ ক্রমশ কূটনৈতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়ে।
‘জেনারেশন জেড রেভ্যুলুশন’ এবং শেখ হাসিনার দেশত্যাগ
তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে “জেনারেশন জেড”, ছিল এই পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি। তারা সোচ্চার হয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় সংগঠিত হয়, মাঠে নামে। দমন-পীড়নের মুখেও আন্দোলন থামেনি। বরং শেখ হাসিনার প্রতিটি শক্তি প্রয়োগ আন্দোলনকে আরও বেশি বিস্ফোরণমুখী করে তোলে।
শেষ মুহূর্তে, যখন সেনাবাহিনীর অনেক সদস্যও জনগণের পক্ষ নেয় এবং সরকারের আদেশ মানতে অস্বীকৃতি জানায়, শেখ হাসিনার পায়ের নিচের মাটি সরে যায়। তার পরিবার ও উপদেষ্টাদের চাপের মুখে তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন এবং গোপনে ভারত গমন করেন। পালানোর মুহূর্ত ছিল তার দীর্ঘ ১৬ বছরের ক্ষমতার অন্ধ মোহের এক নির্মম পরিণতি।
শেখ হাসিনার পতনের শিক্ষা
বিশ্ব রাজনীতিতে শেখ হাসিনার পতন নতুন বার্তা দিয়েছে—
কোনো শাসকই জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চিরকাল ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক চেতনার বিজয় একবার আবারও প্রমাণিত হলো বাংলাদেশের মাটিতে।
বিশ্বের অন্যান্য কর্তৃত্ববাদী শাসকদের জন্যও এ এক শক্তিশালী সতর্কবার্তা— জনতার রক্তচাপা ক্ষোভ একদিন না একদিন বিস্ফোরিত হবেই। বাংলাদেশের ছাত্র ও যুবসমাজ সেটাই দেখিয়ে দিলো।
এবার বাংলাদেশের সামনে রয়েছে নতুন এক সম্ভাবনার দিগন্ত। শক্তিশালী, জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতে পরিচালিত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন এখন নতুন করে জাগ্রত হয়েছে।