অনিরাপদ ডায়ালাইসিস: ৭০ শতাংশ কিডনি রোগী হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত

health kidney

বাংলাদেশে কিডনি রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ডায়ালাইসিস প্রক্রিয়ায় অব্যবস্থাপনা ও অনিরাপদ রক্ত সঞ্চালনের কারণে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়ছেন হাজারো রোগী। চিকিৎসা গাইডলাইন লঙ্ঘনের মাধ্যমে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন প্রায় ৭০ শতাংশ কিডনি রোগী — এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে সাম্প্রতিক এক গবেষণায়।

ডায়ালাইসিসই যখন মৃত্যুঝুঁকির কারণ

কিডনির স্বাভাবিক কার্যকারিতা হারানোর পর রোগীর জীবন রক্ষায় প্রধান ভরসা হয়ে ওঠে ডায়ালাইসিস। কিন্তু সেই প্রক্রিয়াই যখন হয়ে ওঠে ভাইরাস সংক্রমণের কারণ, তখন তা শুধু চিকিৎসা নয়, মানবাধিকার প্রশ্নে দাঁড়িয়ে যায়। সরকারি ও বেসরকারি বহু হাসপাতালেই হেপাটাইটিস পজিটিভ রোগীদের জন্য আলাদা ডায়ালাইসিস মেশিনের ব্যবস্থা না থাকায় সাধারণ রোগীরাও ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন।

সরবরাহ সংকট ও চরম ভোগান্তি

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’ পজিটিভ কিডনি রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডায়ালাইসিস মেশিন নেই। যার ফলে একাধিক রোগী একই মেশিন ব্যবহার করছেন, সংক্রমণের ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যাচ্ছে।

জসিম উদ্দিন (৪০), দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে ডায়ালাইসিস করছেন। তিনি জানান, একসময় তিনিও হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হন। যদিও বর্তমানে জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটে ‘সি’ ভাইরাস পজিটিভদের জন্য নির্ধারিত মেশিনে সেবা পাচ্ছেন, কিন্তু এর আগে দীর্ঘদিন ভোগান্তিতে থাকতে হয়েছে।

দুঃখজনক পরিণতি

দেলোয়ার হোসেন তার খালুর কিডনি রোগ ও ডায়ালাইসিস অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন, যিনি অবশেষে হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরে, কোথাও সঠিক সেবা না পেয়ে জীবন হারিয়েছেন তার প্রিয়জন।

পরিসংখ্যান ও চ্যালেঞ্জ

ক্যাম্পস-এর প্রতিষ্ঠাতা ডা. এমএ সামাদ বলেন, দেশে প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ কোনো না কোনোভাবে কিডনি সমস্যায় আক্রান্ত। প্রতিবছর ৪০ হাজারের বেশি রোগী ডায়ালাইসিসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন, কিন্তু তাদের মাত্র ১০ শতাংশ চিকিৎসা নিতে সক্ষম হন।

নীতিমালা ও বাস্তবতা

জাতীয় গাইডলাইন থাকা সত্ত্বেও বহু চিকিৎসাকেন্দ্র তা অনুসরণ করে না। নিয়ম অনুযায়ী, হেপাটাইটিস পজিটিভদের জন্য আলাদা মেশিন, রক্ত স্ক্রিনিং এবং প্রশিক্ষিত জনবল থাকা উচিত। কিন্তু বাস্তবে এর বড় একটি অংশই অনুপস্থিত।

আলো আসুক পরিকল্পনার আলোচনায়

সরকার-পিপিপি অংশীদারিত্বে ‘স্যান্ডর ডায়ালাইসিস সার্ভিসেস বাংলাদেশ লিমিটেড’ বর্তমানে কিছু হাসপাতাল পরিচালনা করছে। তবে তাদের মেশিন সংখ্যাও যথেষ্ট নয়। কিডনি ইনস্টিটিউটে ‘বি’ ভাইরাসের জন্য ৪টি এবং ‘সি’ ভাইরাসের জন্য ১০টি মেশিন, চট্টগ্রামে ৬টি মেশিন — এ পরিসংখ্যানই সংকটের গভীরতা বোঝায়।

সমাধানে কী প্রয়োজন?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অবস্থার উন্নয়নে জরুরি ভিত্তিতে নিচের বিষয়গুলো নিশ্চিত করা দরকার:

  • হেপাটাইটিস পজিটিভদের জন্য পৃথক ডায়ালাইসিস ইউনিট
  • নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন ও স্ক্রিনিং
  • আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল
  • ডায়ালাইসিস সেন্টারগুলোকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনা

একটি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন শুধু অবকাঠামো নয়, ব্যবস্থাপনার ওপরও নির্ভর করে। অনিরাপদ ডায়ালাইসিস যেন আর কোনো পরিবারে শোক নিয়ে না আসে, তার জন্য এখনই প্রয়োজন সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ ও আন্তরিক উদ্যোগ।


📌 দ্য মানডে টাইমস | জনস্বাস্থ্যের পক্ষে, অনিয়মের বিপক্ষে।
(এই প্রতিবেদনটি তথ্যভিত্তিক এবং সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করতেই প্রকাশিত।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *