বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের নতুন অধ্যায়: পররাষ্ট্র সচিবদের বৈঠকে আশাবাদের সুর

দীর্ঘ ১৫ বছর পর ঢাকা শহর সাক্ষী হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক উদ্যোগের—বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক। বৃহস্পতিবার ঢাকার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে অনুষ্ঠিত এই বৈঠক শুধু দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের পুনর্জাগরণ নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা বলেও মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।
পটভূমি: সম্পর্কের ইতিহাস ও টানাপোড়েন
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক কখনোই খুব সহজ ছিল না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং সেই সময় সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো দুই দেশের মধ্যে এক দীর্ঘস্থায়ী অনাস্থা সৃষ্টি করে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও পাকিস্তান কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি, যা বাংলাদেশের জনগণের মনে আঘাত হেনে রেখেছে।
বিশেষ করে ২০১৩ সালে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর পাকিস্তানের সংসদে ‘উদ্বেগ প্রকাশ’ করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ, এরপর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড নিয়ে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া—সব মিলিয়ে সম্পর্কের অবনতি ঘটে দ্রুত। বাংলাদেশ একাধিকবার পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানায়।
এরপর কূটনৈতিক স্তরে কার্যত নিরবতা নেমে আসে। ২০১০ সালের পর আর কোনো সচিব পর্যায়ের বৈঠক হয়নি, বন্ধ ছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সফরও।
রাজনৈতিক পালাবদল ও সম্পর্ক পুনঃসূচনা
২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় পরিবর্তন আসে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেন। রাজনৈতিক এই রদবদলের প্রেক্ষিতে পাকিস্তান থেকেও শুভেচ্ছা ও সমর্থনের বার্তা আসে।
এরপর জাতিসংঘ অধিবেশনের সময় অধ্যাপক ইউনূস ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের সাইডলাইন বৈঠকে দুই দেশ ‘সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের’ বিষয়ে একমত হয়। এরপর থেকেই কূটনীতিকদের মাঝে বাড়ে আন্তঃক্রিয়া, সক্রিয় হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়গুলো।
বৈঠকের মূল এজেন্ডা: সম্পর্ক পুনরুদ্ধার ও বাণিজ্য
ঢাকায় অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সচিব পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নিতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসেন। বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিন।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, এবার আলোচনার বিষয়বস্তু নির্দিষ্ট কিছু সীমায় আবদ্ধ ছিল না। বরং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, কানেকটিভিটি, আঞ্চলিক নিরাপত্তা, সার্কের ভবিষ্যৎ, সাংস্কৃতিক বিনিময়, শিক্ষার্থী ও নাগরিক পর্যায়ের যোগাযোগ—সব কিছুই আলোচনায় উঠে আসে।
বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও ব্যবসা-বাণিজ্য। বর্তমানে পাকিস্তান বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৬৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, যার মধ্যে সুতা, কাপড় ও চামড়া অন্যতম। বাংলাদেশ রপ্তানি করে মাত্র ৬ কোটি ডলারের পণ্য—কাঁচা পাট, তৈরি পোশাক, চা ও ওষুধপণ্য।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও কৌশলগত স্বার্থ
এই বৈঠককে কেন্দ্র করে উভয় দেশের মধ্যে নতুন উচ্চ পর্যায়ের সফরের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। চলতি মাসেই পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের ঢাকা সফরের কথা ভাবা হচ্ছে, যা সফল হলে ২০১২ সালের পর এই প্রথম কোনো পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর হবে।
বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের একটি অংশ মনে করছেন, পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার সাথে বাণিজ্যিক রুট খোলা যেতে পারে। বিশেষ করে করাচি বন্দরের মাধ্যমে আফগানিস্তান, ইরান ও তুর্কেমেনিস্তান থেকে পণ্য আমদানি সহজ হবে।
বিশ্লেষক সাহাব এনাম খান বলছেন, “এখন সময় হয়েছে সম্পর্ককে বাস্তবভিত্তিক আকারে রূপ দেওয়ার। শুধু অতীত নয়, বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
আঞ্চলিক রাজনীতি ও ভারতের ভূমিকা
এই আলোচনার প্রেক্ষাপটে ভারতও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক কিছুটা শীতল হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পাকিস্তান এই সুযোগ কাজে লাগাতে চায়—এমনটা মনে করেন অনেকে। পাশাপাশি বাংলাদেশের চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা পাকিস্তানের কৌশলগত পরিকল্পনার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ।
এছাড়া সার্ক (SAARC) ফোরাম পুনরুজ্জীবনের উদ্যোগও আলোচনায় উঠে আসে। এক সময় কার্যত স্থবির হয়ে যাওয়া এই আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্মটি নতুন করে সচল হলে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, বাণিজ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে ধারণা করা হয়।
ভবিষ্যতের পথে: প্রতিবন্ধকতা ও সম্ভাবনা
দুই দেশের অতীত সম্পর্কের জটিলতা কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া সহজ হবে না। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের যুদ্ধ এবং যুদ্ধাপরাধ নিয়ে এখনও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বিদ্যমান। তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কৌশলগত পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে বাস্তবমুখী করে তোলা সম্ভব।
সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেন, “বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক সম্পর্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যোগাযোগ, বাণিজ্য ও নিরাপত্তায় একযোগে কাজ করলে উভয় দেশেরই লাভ হবে।”
বাংলাদেশ-পাকিস্তান পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক নিঃসন্দেহে দুই দেশের সম্পর্কের নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। এই আলোচনা শুধু দুই দেশের মধ্যকার আস্থার সংকট কাটাতে সাহায্য করবে না, বরং দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক অঙ্গনেও একটি ইতিবাচক বার্তা পাঠাবে।
রাজনৈতিক সদিচ্ছা, অর্থনৈতিক যৌথতা এবং আঞ্চলিক বাস্তবতা—এই তিনকে সামনে রেখেই হয়তো ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এক নতুন সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে তুলবে, যেখানে পারস্পরিক স্বার্থ ও সম্মানের ভারসাম্য বজায় থাকবে।